কবিতা

প্রণয়ের প্রথম চুম্বন

( ১ )

মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!
যবে তুমি মুক্ত কেশে,
ফুলরাণী বেশে এসে,
করেছিলে মোরে প্রিয় স্নেহ-আলিঙ্গন!
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন?

( ২ )
প্রথম চুম্বন!
মানব জীবনে আহা শান্তি-প্রস্রবণ!
কত প্রেম কত আশা,
কত স্নেহ ভালবাসা,
বিরাজে তাহায়, সে যে অপার্থিব ধন!
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!

( ৩ )
হায় সে চুম্বনে
কত সুখ দুঃখে কত অশ্রু বরিষণ!
কত হাসি, কত ব্যথা,
আকুলতা, ব্যাকুলতা,
প্রাণে প্রাণে কত কথা, কত সম্ভাষণ!
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!

( ৪ )
সে চুম্বন, আলিঙ্গন, প্রেম-সম্ভাষণ,
অতৃপ্ত হৃদয় মূলে
ভীষণ ঝটিকা তুলে,
উন্মত্ততা, মাদকতা ভরা অনুক্ষণ,
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!

দেশের বাণী

কে আর বুঝিবে হায় এ দেশের বাণী?
এ দেশের লোক যারা,
সকলইতো গেছে মারা,
আছে শুধু কতগুলি শৃগাল শকুনি!
সে কথা ভাবিতে হায়
এ প্রাণ যে ফেটে যায়,
হৃদয় ছাপিয়ে উঠে — চোখ ভরা পানি |
কে আর বুঝিবে হায় এ দেশের বাণী!
এ দেশের লোক যত
বিলাস ব্যসনে রত
এ দেশের দুঃখ কিছু নাহি বুঝে তারা |
 দেশ গেল ছারেখারে,
এ কথা বলিব কারে?
ভেবে ভেবে তবু মোর হয়ে গেছে সারা!
প্রাণভরা হাহাকার
চোখ ভরা অশ্রুধার,
এ হৃদি যে হয়ে গেছে মরুভূমি-পারা!
এ দেশের দুঃখ কিছু নাহি বুঝে তারা?

আযান

কে ওই শোনাল মোরে আযানের ধ্বনি।
মর্মে মর্মে সেই সুর, বাজিল কি সুমধুর
আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী।
কি মধুর আযানের ধ্বনি!
আমি তো পাগল হয়ে সে মধুর তানে,
কি যে এক আকর্ষণে, ছুটে যাই মুগ্ধমনে
কি নিশীথে, কি দিবসে মসজিদের পানে।
হৃদয়ের তারে তারে, প্রাণের শোণিত-ধারে,
কি যে এক ঢেউ উঠে ভক্তির তুফানে-
কত সুধা আছে সেই মধুর আযানে।
নদী ও পাখির গানে তারই প্রতিধ্বনি।
ভ্রমরের গুণ-গানে সেই সুর আসে কানে
কি এক আবেশে মুগ্ধ নিখিল ধরণী।
ভূধরে, সাগরে জলে নির্ঝরণী কলকলে,
আমি যেন শুনি সেই আযানের ধ্বনি।
আহা যবে সেই সুর সুমধুর স্বরে,
ভাসে দূরে সায়াহ্নের নিথর অম্বরে,
প্রাণ করে আনচান, কি মধুর সে আযান,
তারি প্রতিধ্বনি শুনি আত্মার ভিতরে।
নীরব নিঝুম ধরা, বিশ্বে যেন সবই মরা,
এতটুকু শব্দ যবে নাহি কোন স্থানে,
মুয়াযযিন উচ্চৈঃস্বরে দাঁড়ায়ে মিনার ‘পরে
কি সুধা ছড়িয়ে দেয় উষার আযানে!
জাগাইতে মোহমুদ্ধ মানব সন্তানে।
আহা কি মধুর ওই আযানের ধ্বনি।
মর্মে মর্মে সেই সুর বাজিল কি সমধুর
আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী।

সায়াহ্নে

হে পান্থ, কোথায় যাও কোন দূরদেশে
কার আশে? সে কি তোমা করিছে আহŸান?
সম্মুখে তামসী নিশা রাক্ষসীর বেশে
শোন না কি চারিদিকে মরণের তান!
সে তোমারে ওহে পান্থ, হাসিমুখে এসে,
সে তোমারে ছলে বলে গ্রাসিবে এখনি।
যেয়োনা একাকী পান্থ, সে দূর বিদেশে,
ফিরে এসো, ওহে পান্থ, ফিরে এসো তুমি।
এ ক্ষুদ্র জীবন লয়ে কেন এত আশা?
জান না কি এ জগত নিশার স্বপ্ন?
মায়া মরীচিকী প্রায় ¯েœহ ভালবাসা—
জীবনের পাছে ওই রয়েছে মরণ
হে পান্থ হেথায় শুরু আঁধারের স্তর;
মৃত্যুর উপর মৃত্যু, মৃত্যু তার পর!

প্রার্থনা

বিভো, দেহ হৃদে বল!
না জানি ভকতি, নাহি জানি স্তুতি,
কি দিয়া করিব তোমার আরতি
আমি নিঃসম্বল!
তোমার দুয়ারে আজি রিক্ত করে
দাঁড়ায়েছি প্রভো, সঁপিতে তোমারে
শুধু আঁখি জল,
দেহ হৃদে বল!
বিভো, দেহ হৃদে বল!
দারিদ্র পেষণে, বিপদের ক্রোড়ে,
অথবা সম্পদে, সুখের সাগরে
ভুলিনি তোমারে এক পল,
জীবনে মরণে, শয়নে স্বপনে
তুমি মোর পথের সম্বল;
দেহ হৃদে বল!
বিভো, দেহ হৃদে বল!
কত জাতি পাখি, নিকুঞ্জ বিতানে
সদা আত্মহারা তব গুনগানে,
আনন্দে বিহবল!
ভুলিতে তোমার, প্রাণে অবসাদ,
তরুলতা শিরে, তোমারি প্রসাদ
চারু ফুল ফল!
দেহ হৃদে বল!
বিভো, দেহ হৃদে বল!
তোমারি নিঃশ্বাসে বসন্তের বায়ু,
তব স্নেহ কণা জগতের আয়ু,
তব নামে অশেষ মঙ্গল!
গভীর বিষাদে, বিপদের ক্রোড়ে,
একাগ্র হৃদয়ে স্মরিলে তোমারে
নিভে শোকানল!
দেহ হৃদে বল!

বঙ্গভূমি ও বঙ্গভাষা

বাংলা আমার মাতৃভাষা
বাংলা আমার জন্মভূমি।
গঙ্গা পদ্মা যাচ্ছে ব’য়ে,
যাহার চরণ চুমি।
ব্রহ্মপুত্র গেয়ে বেড়ায়,
যাহার পূণ্য-গাথা!
সেই-সে আমার জন্মভূমি,
সেই-সে আমার মাতা!

আমার মায়ের সবুজ আঁচল
মাঠে খেলায় দুল!
আমার মায়ের ফুল-বাগানে,
ফুটছে কতই ফুল!
শত শত কবি যাহার
গেয়ে গেছে গাথা!
সেই-সে আমার জন্মভূমি,
সেই-সে আমার মাতা!

আমার মায়ের গোলা ছিল,
ধন ধান্যে ভরা!
ছিল না তার অভাব কিছু,
সুখে ছিলাম মোরা!
বাংলা মায়ের ¯িœগ্ধ কোলে,
ঘুমিয়ে রব আমি!
বাংলা আমার মাতৃভাষা
বাংলা জন্মভূমি!..

সুখ

সুখ সুখ’ বলে তুমি কেন কর হা-হুতাশ,
সুখ ত পাবে না কোথা, বৃথা সে সুখের আশ!
পথিক মরুভূ মাঝে খুঁজিয়া বেড়ায় জল,
জল ত মিলে না সেথা, মরীচিকা করে ছল!
তেমতি এ বিশ্ব মাঝে, সুখ ত পাবে না তুমি,
মরীচিকা প্রায় সুখ, – এ বিশ্ব যে মরুভূমি!
ধন রত সুখৈশ্বর্য কিছুতেই সুখ নাই,
সুখ পর-উপকারে, তারি মাঝে খোঁজ ভাই!
‘আমিত্ব’কে বলি দিয়া স্বার্থ ত্যাগ কর যদি,
পরের হিতের জন্য ভাব যদি নিরবধি!
নিজ সুখ ভুলে গিয়ে ভাবিলে পরের কথা,
মুছালে পরের অশ্রু – ঘুচালে পরের ব্যথা!
আপনাকে বিলাইয়া দীনদুঃখীদের মাঝে,
বিদূরিলে পর দূঃখ সকালে বিকালে সাঁঝে!
তবেই পাইবে সুখ আত্মার ভিতরে তুমি,
যা রুপিবে- তাই পাবে, সংসার যে কর্মভূমি!